
বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে ঢাকার মতো বিভাগীয় শহরগুলোতে শিল্প-কারখানা বৃদ্ধি, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বাতাসের গুনগত মান দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইনডেক্স অনুযায়ী-
- বর্তমানে ঢাকার বাতাসের একিউআই স্কোর ৭৪ যা মাঝারি মান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই মানের বাতাস বিশেষ করে সংবেদনশীল ব্যাক্তিদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
- এছাড়াও, ঢাকার বার্ষিক গড় একিউআই স্কোর ১৬৮, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা নির্ধারিত বাতাসের মান সমূহ-
- ০–৫০ একিউআইঃ এই স্কোর মূলত ভাল বাতাসের মানকে বোঝায়। এতে কোনো স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই।
- ৫১–১০০ একিউআইঃ এই স্কোর মাঝারি বাতাসের মান নির্দেশ করে। এটি সংবেদনশীল ব্যক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে।
- ১০১–১৫০ একিউআইঃ এই স্কোর সংবেদনশীল ব্যক্তিদের জন্য অস্বাস্থ্যকর বাতাসের ইঙ্গিত দেয়। তাই সংবেদনশীল ব্যক্তিদের সতর্ক থাকা উচিত।
- ১৫১–২০০ একিউআইঃ এই স্কোর অস্বাস্থ্যকর বাতাসের ইঙ্গিত দেয়, যা সকলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
- ২০১–৩০০ একিউআইঃ এই স্কোর অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বাতাসের মান নির্দেশ করে, যা সকলের জন্য গুরুতর ঝুঁকি।
- ৩০১+ একিউআইঃ এই স্কোর অত্যন্ত বিপজ্জনক বাতাস নির্দেশ করে, যা সকলের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।
এই বাতাস থেকে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে। এছাড়াও, এই ধরণের বাতাস ছোট বাচ্চাদের বৃদ্ধির উপর খারাপ প্রভাব ফেলে। কিন্তু চিন্তা করবেন না - আপনার প্রিয়জনদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রদানের জন্য আপনার বাড়ির বাতাসকে প্রাকৃতিক এবং যান্ত্রিক উভয়ভাবেই বিশুদ্ধ করার অনেক উপায় রয়েছে। যদি আপনার বাজেট বেশি থাকে তাহলে আপনি উভয়ই ব্যবহার করতে পারেন। তাহলে চলুন আপনার ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ করার ১০টি কার্যকর উপায় সম্পর্কে জেনে নেয়।
১। এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার
এয়ার পিউরিফায়ার হচ্ছে বাসা-বাড়িতে বাতাসের মান উন্নত করার সবচেয়ে কার্যকর ডিভাইস। এটি বাতাস থেকে ধুলো, ধোঁয়া, অ্যালার্জেন এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক কণা সহজে অপসারণ করে। ভাল মানের এয়ার পিউরিফায়ার দূষণকারী পদার্থ ফিল্টার করতে সাহায্য করে। এই ধরণের ডিভাইসে হেপা ফিল্টার এবং ইউভি-সি লাইট এর মত উন্নত ফিল্টার টেকনোলোজি রয়েছে, যা বাতাসে ভাসমান কণা সহজে পরিশোধন করে এবং বাতাসের উন্নত গুণমান বজায় রাখে।
২। নিয়মিত ধুলোবালি পরিষ্কার
বাহ্যিক দূষণের কারণে বাসা-বাড়িতে ধুলোবালি জমে থাকা একটি সাধারণ সমস্যা। বাসা-বাড়িতে ধুলোবালি জমা হওয়া রোধ করার জন্য নিয়মিত পরিষ্কার করা অপরিহার্য। বিশেষ করে শুষ্ক আবহাওয়ায় বা গরমকালে বাসা-বাড়িতে আসবাবপত্র, তাক এবং মেঝেতে ঘন ঘন ধুলোবালি জমা হয়। ছোট বালিকণা, ফাংগাস দূর করার জন্য হেপা ফিল্টার যুক্ত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করতে পারেন।
৩। বাতাসের জন্য জানালা খোলা রাখা
আপনার বাড়ির ভিতরে ভাল বাতাস চলাচল বজায় রাখার জন্য সঠিক বায়ুচলাচল নিশ্চিত করতে হবে। বর্ষাকালে বাইরের বাতাস যথেষ্ট পরিষ্কার থাকে, তাই এই সময় রুমের জানালা খোলা রাখবেন, যা সতেজ বাতাস চলাচলে সহায়তা করবে। ফলে ঘরের ভিতরে দূষণকারী পদার্থ জমা থাকবে না পাশাপাশি আপনার থাকার জায়গাকে সতেজ থাকবে। তবে, শীত বা শুষ্ক মৌসুমে ঘরের জানালা খোলার আগে বাইরের বাতাসের একিউআই স্কোর পরিমান করে নেওয়া উচিত।
৪। প্রাকৃতিক বাতাস পরিশোধনের জন্য রুমে গাছ
কিছু কিছু গৃহস্থালির গাছ বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে এবং অক্সিজেন সরবারহ করে বাতাসকে বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে। বাতাস পরিশোধনের জন্য সেরা কিছু উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে স্নেক প্ল্যান্ট, পিস লিলি,ব্যাম্বো প্ল্যান্ট, লেডি পাম, গোল্ডেন পোথোস, বাটারফ্লাই পাম, আরিকা পাম, ঘৃতকুমারী এবং ইংলিশ আইভি। এই গাছগুলো কেবল আপনার রুমের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে না বরং প্রাকৃতিকভাবে বাতাস গুনমান উন্নত করতে কার্যকরভাবে কাজ করে।
৫। ঘরে ধূমপান এড়িয়ে চলুন
বাসা-বাড়িতে বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ধূমপান। সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্ষতিকারক রাসায়নিক থাকে যা ঘন্টার পর ঘন্টা বাতাসে থাকতে পারে। ফলে বাতাসের গুণমান এবং পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য উভয়ের জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে। আপনার বাড়ির ভিতরের বাতাস উন্নত করতে, ঘরের ভিতরে ধূমপান এড়িয়ে চলবেন, অথবা ভাল বাতাস চলাচল এরিয়াতে ধূমপান সীমাবদ্ধ রাখবেন।
৬। অভ্যন্তরীণ আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ
বাতাসে অতিরিক্ত আর্দ্রতা থাকলে রুমের ভিতরে ছত্রাক বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি থাকে, যা কেবল অস্বস্তিকর নয় বরং রুমের বাতাসের গুণমানও খারাপ করে। আর্দ্রতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বাসা-বাড়িতে ডিহিউমিডিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন। এটি ছত্রাকের বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে এবং রুমের বাতাসকে সতেজ রাখে।
৭। প্যারাফিন মোমবাতি ব্যবহার
সাধারণ মোমবাতির পরিবর্তে প্যারাফিন মোমবাতি ব্যবহার করতে পারেন। এটি জ্বালালে এক ধরনের সুগন্ধ বের হয় যা বাতাসে থাকা ধূলিকণা থেকে সৃষ্ট অ্যালার্জি কমাতে সাহায্য করে। প্যারাফিন মোমবাতি ঘরের বাতাস ও গন্ধ কার্যকর ভাবে দূর করতে পারে।
৮। রাসায়নিক দিয়ে তৈরি ক্লিনার ব্যবহার কমিয়ে দিন
অনেকে বাড়ির রুম পরিষ্কারের জন্য রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরণের ক্লিনার ব্যবহার করে থাকেন যা বাতাসে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে। ভিনেগার, বেকিং সোডা বা লেবুর মতো উপাদান দিয়ে তৈরি ক্লিনার ব্যবহার করবেন। এই প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি ক্লিনার বাতাসে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নির্গমন কমানোর সাথে সাথে আপনার ঘরকে কার্যকরভাবে পরিষ্কার করতে সহায়তা করে।
৯। রুম শুষ্ক রাখবেন
ফাঙ্গাস, ছাঁচ সাধারণত স্যাঁতসেঁতে, ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি হয়ে থাকে এবং ঘরের বাতাসের গুণমান খারাপ করে থাকে। ছত্রাক প্রতিরোধ করতে, আপনার বাড়িতে যেকোনো ফুটো মেরামত করে নিবেন এবং প্রয়োজনে এক্সজস্ট ফ্যান ব্যবহার করবেন। এছাড়াও, আপনার বাথরুম এবং রান্নাঘর সঠিকভাবে বায়ুচলাচল করে কিনা তাও যাচাই করবেন।
১০। ডিফিউসার ব্যবহার
বাতাস বিশুদ্ধকরণের জন্য ডিফিউসারের মাধ্যমে দারুচিনি, ওরেগানো, রোজমেরি, থাইম, বাতাবি লেবু, লবঙ্গ ইত্যাদি তেল ব্যবহার করতে পারেন। এটি ঘরের বাতাসকে ছত্রাকমুক্ত রাখে। এছাড়া, ইউক্যালিপটাস এবং পুদিনা তেল ডিফিউসার এর মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারেন যা ঘরের মশা-মাছি দূর করতে সাহায্য করবে এবং রুমের বাতাসে সতেজ সুবাস ছড়িয়ে দিবে।
এই সহজ পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করে, আপনি সহজেই আপনার বাড়ির বাতাসের মান উন্নত করতে পারেন এবং একটি স্বাস্থ্যকর থাকার জায়গা উপভোগ করতে পারেন।
এই প্রবন্ধটি পোস্ট করা হয়েছে: June 16, 2025